শক্তির খোঁজে

শক্তির খোঁজে

Anuradha Mukhopadhyay

আবার একটি বছর ঘুরে মার ঘরে ফেরার দিনটি ঘনিয়ে এলো। একটি অদ্ভুত অনুভূতি মনে আসে আর বুঝতে পারি না সেটা শুধুই নির্ভেজাল আনন্দ কিনা। মনের অনেক নিভৃতে একটা অস্বস্তি আমাকে যেন কুরে কুরে খায়, মনে হয় যেন আপাত দৃষ্টিতে সব ঠিকই আছে, তবু কি যেন আর নেই! কি অদ্ভুত এই অনুভূতি! যার কোনো বিশ্লেষণ নেই!

সবই আছে, নীল আকাশ, সোনা রোদ, পান্ডেলের তোড়জোড়। দেশে নিশ্চয় পুজোর বাজার জমে উঠেছে রমরমিয়ে। পাড়ায় পাড়ায় পান্ডেলের কাঠামো, চাঁদার বিল হাতে ছেলেদের আনাগোনা। বাড়িতে বাড়িতে নতুন জামাকাপড় কেনাকাটার ব্যস্ততা। যাঁরা পুজোয় বাইরে বেরাতে যাবেন, তাঁরাও হয়তো গোছগাছ শুরু করেছেন। সব জায়গাতেই একটা উৎসবের মেজাজ।

তবু কি যেন নেই! সে কি আমার মনে? কি নেই? কেন নেই? মনের ভেতরে ঢাকের শব্দটা শুনতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আগস্টের শুরুতে একটি নারকীয় ঘটনায় ঢাকের শব্দটা মরে গেলো। নৃশংসতার চূড়ান্ত উদাহরণ এই ঘটনা। কীভাবে, কেন, পরপর এই প্রশ্নগুলি মনের ভিতরে ঘুরপাক খেতে লাগলো। মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাসের ভিত্তিটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। ১ মাসের অনেক প্রহসনের পরে মানুষের উত্তরের খোঁজে নেমে এলো রাস্তায়। বিচার দাও, বিচার চাই।

কে জানে, এই ঘটনার আগে পরে আরো কত মেয়ে বোঝাতে চড়ে গেলো গোপনে। বিচার! কি সেটা? এত সহজলভ্য?

আজ আমি ভেবেছিলাম কলম ধরবই না। স্বাধীনতা নিয়ে কোনো উক্তি করব না। যে ঝড় বয়ে গেল আমার জন্মস্থানে এবং সাংবাদিকদের ঘটনার বিবরণে আমার মনে হলো, ব্যস আর না, কোনো শব্দ না… শুধু নিঃশব্দতা বিরাজিত হোক চারপাশে। কান পেতে শোনো…. ওই মা-বাবার হাহাকার। মৃতার আত্মাও হয়তো চিৎকার করে নালিশ করছে কিন্তু কেউ শুনছে কি? আমরা ব্যস্ত আমাদের বক্তব্য সবার কাছে তুলে ধরতে। আমরা সহমর্মিতার পরাকাষ্ঠটা প্রকাশে ব্যস্ত!! বোঝাতে চাই আমরা কতটা দুঃখী। নিশ্চয় দুঃখী কিন্তু অস্থির বেশী যে এই নারকীয় ঘটনা ঘটেছে।

আগে পরে কিন্তু ঘটেছে এবং ঘটবে… আমরা তাও আশ্চর্য হই, কষ্ট পাই, অসহ্য ক্রোধে চেঁচাই, সভা করি, মোমবাতি জ্বালাই, প্রতিকার চাই। তারপর যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

তদন্ত চলে… কতটা সত্যি আমরা জানতে পাই সেটাও ভাবার বিষয়। কিন্তু যে নৃশংসতার শিকার হয়ে চলে গেলো তার কিন্তু মরেও নিস্কৃতি নেই! সে এখনও বলাৎকারিত হচ্ছে প্রতিদিন… তার স্মৃতি দলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত… কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, কোথায় হয়েছে ইত্যাদি।

মেয়েটার মরেও শান্তি নেই!

হায়রে আমার অভাগা দেশ। কত প্রহসন দেখবি তুই? তোর গায়ের বস্ত্র কবে গেছে চুরি… সে নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই… আমরা মতামত দিতে ব্যস্ত।

ভেব না, মেয়ে… কিছু না কিছু বিচার হবে, আসামী সত্যি হোক বা সাজানো। তারপর সব থেমে যাবে আগের মতো… শুধু ভাবি, এর পরেরটা কবে? নাকি বলি চড়ে গেছে কিন্তু কেউ জানল না… কে জানে!

চলো সভা করি, মিছিলে হাঁটি আর অপেক্ষা করি পরেরটার জন্য।

ও, মেয়ে, আর আসিস না এখানে। আমরা মাটির মূর্তির পায়ে মাথা নীচু করে মা বলি কিন্তু রক্তমানুষের মাকে ভোগের বস্তু মনে করি।

আর এক মৃন্ময়ী মার আসবার শব্দ শুনছো? কী চোখে দেখব তাঁকে?

স্বাধীন ভারত… সত্যি????

মা আসছেন। জগৎজননী মা। তাঁর আবাহনে মেতে উঠবার কথা আমাদের কিন্তু কাঁটাটা যে বিধে গেলো বুকের ভিতরে তার কী হবে?

জীবনের অপরাহ্নে পৌঁছে গেলাম প্রায়। তবু মনে হয়, এই তো শুরু। কিছু মানুষের কুকর্ম যখন হতাশায় ঢেকে দেয় মন, তখন ভিতর থেকে কে যেন হঠাৎই গা ঝাড়া দিয়ে নড়ে বসে, তার চোখে থাকে আগুন, বুকের মধ্যে বাজে সিংহের গর্জন, আর নিধনের দামামা। রাতের স্বপ্ন ছেয়ে থাকে খুনের আবীর মাখা রক্ত রঙে। রক্তলাল শাড়ী তার পরণে। এলোথেলো আঁচল লুটিয়ে আছে মাটিতে, চোখে তীব্র দৃষ্টি, আগুন ঝরছে। চুলগুলো বাঁধনছাড়া হয়ে উড়ছে ইতিউতি আর হাতে একটি রক্তাত্ত ত্রিশুল। অন্ধকার রাতে সে দাঁড়িয়ে এক উত্তাল সাগরের সংগমে। সমুদ্রের গর্জন আর আকাশের বিদ্যুতের ঝিলিক মিলেমিশে জন্ম দিয়েছে এক অলৌকিক পরিবেশের। দূরে ঢেউয়ের টানে মিলিয়ে যাচ্ছে কিছু পাপীর দেহ। তাদের ভয়ার্ত চীৎকার ঢেকে গেছে মেঘের গর্জনে আর এই নারীর উত্তাল নির্মম অট্টহাসিতে।

মাগো, এবার তুমি এসো, পৃথিবীর পাপের ঘড়া যে পূর্ণ হয়েছে… তুমি ত্রিশুলে অসুর বধ করো আর বলে দাও, এই আমরা, নারীর তকমা লাগানো আমাদের গায়ে, আমরা কারা? হয়তো সবার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অনাবিষ্কৃত দূর্গা আবিষ্কারের অপেক্ষায়! কবে হবে মোক্ষলাভ? কবে আমরা দূর্গা হবো?

CATEGORIES:

Bengali

Tags:

Comments are closed