আগমনী
জন্মভূমির সেই পুজোর দিনগুলো আজও খুব মনে পড়ে। কত মিষ্টি ও মধুর সেই স্মৃতিগুলো যেন মৌমাছির ঝাঁকের মতো মনের ফুলের রেণুগুলোর চারিদিকে উড়ছে। আমার জীবনের অনেকটা অংশ যেহেতু কলকাতায় কেটেছে তাই ওই ভৌগোলিক গন্ডির মধ্যেই তার প্রেক্ষাপট। প্রত্যেক বছর কলকাতাবাসী, কালবৈশাখী আর আষাঢ় ও শ্রাবনের বর্ষায় রাস্তার জল জমার ভোগান্তি কাটিয়ে যখন একটু কম উষ্ণ পরিবেশে স্বস্তি পেত, তখন বুঝতে পারতাম শরৎকাল এসে গেছে। বাঙালীর বৃহত্তর উৎসবের মাস। কলকাতার বাইরে একটু গেলেই তখন মাঠে মাঠে সাদা কাশফুল দুলে দুলে বাঙালিকে সগৌরবে জানাতো, "পুজো আসছে, তোমরা তৈরি তো?" আপামর বাঙালির জীবনযুদ্ধে পুজোর ওই ৫ দিন মাদুর্গা তার স্নেহের ছোঁয়ায় ভুলিয়ে দেয় যত দুঃখ, কষ্ট ও আক্ষেপ।
পুজোর প্রথম অনুভূতি পেতাম মহালয়ার কাকভোরে যখন পাড়াজুড়ে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চন্ডীপাঠ করতেন আর তা ঘুমন্ত চোখ ডোলাতে ডোলাতে মা, বাবার ও বাকি পরিবারের সঙ্গে বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুনতাম। তখন তার কোনো অর্থই হয়তো বুঝতাম না কিন্তু আজ মনে হয় ওই ভোরগুলো আবার ফেরত পেলে কি ভালোই না হতো।
পুজোর ৫ দিনের মধ্যে, সপ্তমী ও অষ্টমীর প্রোগ্রামে কোনো বছর বদল হত না। সপ্তমীর সারা রাত ধরে স্কুলের বন্ধুদের সাথে নর্থ বা সাউথ কলকাতার ঠাকুর দেখা, ডিনার বাইরে করা আর ভোরবেলা আলো ফুটলে বাড়ি ফিরে বিছানায় সারা রাতের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে দুপুর অবধি ঘুমিয়ে পড়া। অষ্টমীর দিনে আরেকটা বন্ধুদের গ্রুপের সঙ্গে সারা রাত বাকি থাকা দিকটার প্যান্ডেলগুলো ঘোরা, বাইরে ডিনার খাওয়া আর তারপর Maddox স্কয়ারে বসে ভোর অবধি আড্ডা দেওয়া। তখন Maddox স্কয়ার "ইয়ং ক্রাউড"র জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, তাই ওটা তাদের আড্ডা ও নতুন বন্ধু বানানোর মিলনক্ষেত্র ছিল। বড় পুজোগুলোর উন্মাদনায় রাস্তায় মানুষের ঢলের মধ্যে বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক পেরিয়ে যখন ওই নামি পুজোগুলোর দুয়ারের লম্বা লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে প্যান্ডেলের ভেতরে ঢুকতাম, তখন মনে হতো কি বিশাল কীর্তির অধিকারী আমরা। অপূর্ব সব থিম-বেজড প্যান্ডেল সাজসজ্জা ও মূর্তি দেখে অতি বড় নাস্তিকও মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারতো না।
বাকি ২ দিনের মধ্যে একদিন বাবা ও মায়ের সঙ্গে কখনো ঠাকুর দেখতে যেতাম বা পাড়ার প্যান্ডেলে সময় কাটাতাম। মাইকেতে অঞ্জলীর মন্ত্রপাঠ শুনতাম আমি আর পুরো পাড়া। বাকি সারাদিন মাইকেতে জোরে জোরে গান বাজতো কিন্তু তার জন্য কেউ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করত না। গানের বৈচিত্র্যও ছিল শোনার মতো, কখনো "উঠ গো, ভারত-লক্ষ্মী " দেশাত্মবোধ জাগাতো আবার কখনো "উড়ি উড়ি বাবা" ফুল এনার্জিতে নাচাতো। বিকেলগুলোই পাড়ার মেয়েরা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ফুচকা আর আলু কাবলি লাইন দিয়ে খেত। আর সেই সময়ের অপেক্ষায় পাড়ার নবতরুণরা তাদের স্মার্ট ড্রেস পরে উল্টো দিকে বসে থাকতো এই আশায় যে তাদের পছন্দের কেউ ওই ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ফিল্মি স্টাইলে বলবে, "হমসে দোস্তি করোগে?"
বিজয়া তো চিরকালই আবেগপ্রবণ বাঙালির শোক ও উদাসীনতার একটি দিনের নাম, যখন কষ্ট হয় যে এত তাড়াতাড়ি পুজোটা শেষ হয়ে গেল? এরপর আবার সেই চিরাচরিত ঘানি টানতে ফেরত যেতে হবে? সিঁদুর খেলার পর যখন মা-কে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে গুরুজনদের প্রণাম সেরে, মিষ্টি ও শরবত খেতাম, তখন শুধু মনে হতো যে দুঃখের দিনকে উদযাপন করে বাঙালি বড় অবিচার করে। সারা বছরই আমরা এরকম মহোৎসবে কেন কাটাতে পারবো না? "আসছে বছর আবার হবে" যতই আমরা বলি, মনের সেই অবসাদ লক্ষীপুজোর নাড়ু, মোয়া ও ক্ষীর খাবার পরেও কিন্তু কিছুতেই কাটেনা।
এতো বছর পরেও আমার মন তার কোনো এক কোণে গুনগুন করে নিরন্তর যেন আজও বিলাপে গেয়েই চলেছে, "মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার, রঙে রঙে ছবি আঁকে।"
Comments are closed