দুর্গাপূজার বিশেষ সম্পাদনা: আমাদের প্রবাসী বাঙালির ঐক্য ও সংস্কৃতি
সুব্রত ভট্টাচার্য
স্বাগতম। পার্থের প্রবাসী বাঙালি সমাজ, ঐকতানের সকল পাঠক-পাঠিকা এবং “বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া”-র সকল সদস্যবৃন্দকে আন্তরিক স্বাগতম। এই পবিত্র সময়ে, যখন আমরা দুর্গাপূজার মহোৎসব উদযাপন করতে প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আমাদের হৃদয়ে একটি বিশেষ অনুভূতি কাজ করছে—ঐক্য, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের শক্তিশালী প্রতিফলন। দুর্গাপূজা, যা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম বৃহত্তম উৎসব, সেটি আমাদের অস্তিত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা একত্রিত হয়ে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রাণবন্ত প্রতীককে সম্মান জানাই।।
বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার অবদান
বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সদস্য, পৃষ্ঠপোষক, স্বেচ্ছাসেবক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের প্রতি আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা। এই প্রতিষ্ঠান যেভাবে বিগত বত্রিশ বছর ধরে পার্থে দুর্গাপূজার আয়োজন করছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
প্রতি বছর পার্থের বাঙালিরা যে উৎসাহ ও নিষ্ঠা নিয়ে এই উৎসব আয়োজন করছে, তা আমাদের সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে।। পার্থের মতো দূর দেশে বসবাস করার পরেও, আমরা যেন আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভুলে না যাই, সে দায়িত্বে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার অবদান অপরিসীম।
সংস্কৃতির উত্তরাধিকার
আমাদের সন্তানদের জন্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই পুজোর মাধ্যমে তারা বাঙালি ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিল্পকলার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, যা তাদের চিন্তার দিগন্ত বিস্তৃত করছে। তারা জানতে পারছে, বাঙালি হওয়া শুধু একটি পরিচয় নয়, এটি আমাদের গর্বের ভিত্তি।
আমরা যদি নিজেদের সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তা শেখানো উচিত। ছোটবেলা থেকে তাদের উৎসাহিত করতে হবে বাড়িতে এবং বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে, তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে বাংলা নাটক, শিল্পীদের সৃষ্টি, এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী গান ও নৃত্য। আমাদের উচিত তাদের উৎসাহিত করা, যেন তারা বাংলা নাটকে এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে, যা তাদের বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং তাদের শিকড়কে বুঝতে সাহায্য করবে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, পুজোর সময় যে সব কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে শিশুরা নিজেদের সংস্কৃতির অংশীদার হয়—গান, নৃত্য এবং চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রকাশ করে। এটি সামগ্রিকভাবে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং একই সঙ্গে আমাদের বাঙালি ঐতিহ্য সংরক্ষণে সাহায্য করে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষাপট
আমাদের সম্প্রদায় সম্প্রতি একটি ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে—কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার তিলোত্তমার প্রতি ঘটে যাওয়া ন্যক্কারজনক অপরাধ। এই ঘটনার প্রতিবাদে আমরা যে সংগঠিত হয়েছি, তা আমাদের ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের পরিচয় দেয়। প্রতিবাদী এই আন্দোলন আমাদের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের সংকল্পকে সুদৃঢ় করে। এখন, দুর্গাপূজার সময় আমাদের উচিত একত্রিত হয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। মা দুর্গার প্রতীকী শক্তির মাধ্যমে আমরা মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করবো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি মনে পড়ে:
“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর।
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী,
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি।”
এই পঙক্তিগুলো আমাদের মুক্ত ভারত সম্পর্কে একটি চিত্র তুলে ধরে। এখানে কবি এমন একটি সমাজের কথা বলছেন যেখানে সব ভয় দূর হয়েছে, এবং সবাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাঁড়াতে পারছে। সেখানে জ্ঞান ও শিক্ষা মুক্ত, এবং সকলের জন্য নিরাপদ ও শান্তির পরিবেশ বিদ্যমান। সারাংশে, আজকের পরিস্থিতিতে এই কবিতা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে একটি মানবিক, মুক্ত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য, যেখানে সকল মানুষ সমান মর্যাদা ও সুযোগ পাবে। মা দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে আমরা যখন এই দুঃখজনক ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শুধু আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তা নয়, আমাদের সমাজের সুরক্ষাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমাপনী ভাবনা
বাঙালির মনন চেতনা পুনর্জাগরণে এই উৎসবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এটি বাঙালির সত্তাকে উদ্দীপিত করে এবং আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি আরও গভীর সংযোগ স্থাপন করে। এই দুর্গোৎসবে আমরা সকলে একত্রিত হয়ে একটি নতুন সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে প্রতিজ্ঞা করি। আমরা মা দুর্গার আশীর্বাদে আমাদের সমাজকে একটি নতুন দিশায় নিয়ে যাই। আমাদের ঐক্য এবং সংহতি আমাদের শক্তিশালী করবে এবং আমাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণে সাহায্য করবে। এই দুর্গাপূজা আমাদের শুধু আনন্দের উৎসব নয়, বরং আমাদের সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক সংহত রূপ। মা দুর্গা আমাদের সকলকে শক্তি দিন, ন্যায় ও সত্যের পথে চলার জন্য প্রেরণা দিন। আসুন, আমরা আমাদের ছোট ছোট বিরোধ ভুলে সঙ্গবদ্ধ হই, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এবং বৃহত্তর সমাজের উন্নতির জন্য লড়াই করি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারব। দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা!
Comments are closed